"তুলাইপাঞ্জি" নামটি দুটি বাংলা শব্দ থেকে এসেছে: “তুলাই” যার অর্থ কোমল বা হালকা এবং “পাঞ্জি” যার অর্থ চাল। এই জাতটির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং এটি শতাব্দী ধরে পশ্চিমবঙ্গে চাষ করা হয়ে আসছে, যার বৈশিষ্ট্যগুলি স্থানীয় রন্ধনপ্রথায় অঙ্গীভূত হয়েছে।
তুলাইপাঞ্জিকে 'অ-বাসমতি সুগন্ধি চাল' হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। এটির গড় দৈর্ঘ্য 5.5 মিমি, দৈর্ঘ্য/প্রস্থ অনুপাত 3.4 এবং প্রসারণ অনুপাত 1.6 সহ মাঝারি-লম্বা সরু দানা রয়েছে।
এই জিআই ট্যাগ করা প্রাচীন লোক চাল 2012 লন্ডন অলিম্পিকে আমাদের অপরাজেয় রন্ধন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেছিল! তুলার (তুলন) মতো সুগন্ধি এবং নরম, এটাই তুলাইপাঞ্জির অর্থ এবং স্বাদ। এর সুগন্ধি এই অ-বাসমতী ভাতকে পুলাও, ভাজা ভাত, বিরিয়ানি এবং পিঠে, পায়েশের মতো মিষ্টান্ন এবং স্থানীয় সুস্বাদু খাবারের জন্য একটি দুর্দান্ত পছন্দ করে তোলে। আমরা প্রায়শই এটি আমাদের রোজের চাল (আমাদের প্রতিদিনের চাল) হিসাবেও ব্যবহার করি।
রান্না করা ভাত খুব সুস্বাদু, গঠনে ভালো, চেহারায় উজ্জ্বল, উচ্চ অ্যামাইলোসকন্টেন্টের কারণে আঠালো নয় এবং ভঙ্গুর। তুলাইপাঞ্জিতে রয়েছে অ্যামাইলোজ- ২৮.৩%, প্রোটিন-৭.৩%।
সম্প্রতি, তুলাইপাঞ্জি চাল তার বিশেষ সুগন্ধ এবং স্বাদের পাশাপাশি পুষ্টিগত উপকারিতার জন্যও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এটি বিশেষত বাংলা রন্ধনশৈলীতে ব্যবহৃত হয়, যেমন পিঠে (চাল কেক) এবং পায়েস (মিষ্টি চালের পুডিং)।
এই চালটি তার মৃদু, বাদামী স্বাদ এবং সুগন্ধের জন্য পরিচিত, যা যে কোনও রান্নায় যোগ করলে তা উন্নত হয়ে ওঠে।
তুলাইপাঞ্জি চালের উপকারিতা:
তুলাইপাঞ্জি চালের বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, যা স্বাস্থ্য-conscious মানুষদের জন্য এটি একটি ভালো পছন্দ করে তোলে। এটি থায়ামিন, নাইসিন, ভিটামিন B6, আয়রন এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো অপরিহার্য পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ।
চালটিতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সহায়ক, যার ফলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং কিছু ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমে যেতে পারে। এছাড়াও, এর উচ্চ ফাইবার কন্টেন্ট পাচন প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সহায়ক।
তুলাইপাঞ্জি চালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হল এর নিম্ন গ্লাইসেমিক সূচক। যেসব খাবারের গ্লাইসেমিক সূচক কম, তা ধীরে ধীরে হজম হয় এবং রক্তে শর্করা বাড়ানোর হার ধীর হয়। এর ফলে, এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে এবং খাওয়ার পর দীর্ঘ সময়ের জন্য তৃপ্তি অনুভূতি বজায় রাখে। আরও কী, তুলাইপাঞ্জি চাল প্রাকৃতিকভাবে গ্লুটেন-মুক্ত, যা সেলিয়াক রোগ বা গ্লুটেন সহনশীলতা সমস্যাযুক্ত মানুষের জন্য উপযোগী।
কিছু গবেষণায় এও প্রমাণিত হয়েছে যে, তুলাইপাঞ্জি চালের উপাদানগুলি কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করতে পারে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি আরও কমিয়ে দিতে পারে। তবে, মনে রাখা উচিত যে তুলাইপাঞ্জি চালের স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি সম্পর্কে আরও গবেষণা প্রয়োজন। যে কোনো খাবারের মতো, এটি সুষম ডায়েটের অংশ হিসেবে পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
উৎপাদনের সময় সীমা :
ঐতিহ্যগতভাবে, তুলাইপাঞ্জি অগাস্ট-ডিসেম্বর সময়কালে বর্ষা মৌসুমের পরে মধ্য-জমি থেকে উঁচু জমিতে এবং বিশেষ করে পাট কাটা ক্ষেতে কোনো সার ব্যবহার না করেই চাষ করা হয়। কম মাটির উর্বরতা এবং আর্দ্রতার চাপ সাধারণত ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্রে বিরাজ করে এবং সুগন্ধের পিছনে মূল কারণ বলে বিশ্বাস করা হয়।
অজৈব সার সাধারণত এই চাল এর সুগন্ধ এবং অন্যান্য গুণগত মান কমিয়ে তোলে আর এই কারণে অজৈব সার তুলাইপাঞ্জি উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় না।
সাল অনুসারে ফলন :
বর্তমানের তথ্য অনুযায়ী খাদ্যরসিকদের জন্য সুখবর। উত্তর দিনাজপুরে জেলার একমাত্র নিজস্ব দেশি ধান তুলাইপাঞ্জি উৎপাদনে রেকর্ড উৎপাদন গড়লেন কৃষকরা। ২০২৪ সালের খারিফ মরশুমে সর্বাধিক বেশি তুলাইপাঞ্জির ফলন হয়েছে উত্তর দিনাজপুরে।
শুধুমাত্র রায়গঞ্জ রায়গঞ্জ মহকুমার নির্দিষ্ট কৃষিজমিতে সুস্বাদু, সুগন্ধে অতুলনীয় তুলাইপাঞ্জি ধান চাষের সুযোগ সীমাবদ্ধ। জেলাজুড়ে প্রায় ২ লক্ষ ৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে উচ্চ ফলনশীল আমন ধান চাষ হয়েছিল। তার মধ্যে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে তুলাইপাঞ্জি ধান চাষ করেছিলেন ২২ হাজার ৩০০ কৃষক।
২০২১ সালের থেকে অন্তত ৬ হাজার মেট্রিন টন বেশি তুলাইপাঞ্জি ধান উৎপাদন হয়েছে। জেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানানো হয়,
২০১৬- ১৭ অর্থবর্ষে মাত্র ৬ হাজার হেক্টর জমিতে তুলাইপাঞ্জি ধান চাষ হত।
২০১৮-১৯ সালে তার পরিমাণ বেড়ে সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে তুলাইপাঞ্জির চাষ হয়।
২০২০-২১ সালে ওই চাষের জমির পরিমাণ বেড়ে ১ হাজার হেক্টর জমিতে তুলাইপাঞ্জি আবাদ হয়েছিল।
২০২১-২২ অর্থবর্ষে সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়।
২০২১-এ ১৮ হাজার মেট্রিন টন তুলাইপাঞ্জি ফলন হয়েছিল। গত বছরের উৎপাদনকে পিছনে ফেলে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ২৪ হাজার মেট্রিন টন,
২০২৩- '২৪ সালে ৩০ হাজার মেট্রিক টন তুলাইপাঞ্জির ফলন হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থাৎ ২০২৫ সালে ৩৬ হাজার মেট্রিক টন তুলাইপাঞ্জি ধান কৃষকের গোলায় উঠেছে বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানানো হয়েছে।
রাজ্য সরকারের প্রকল্প :
সুগন্ধি ধান চাষের জন্য রাজ্য সরকারের তরফে একটি প্রকল্প চালু হয়েছে। জেলার নিজস্ব তুলাইপাঞ্জি আবাদে কৃষকদের বিনামূল্যে তুলাইপাঞ্জির বীজ সরবরাহ করা হয়।
তুলাইপাঞ্জির চাহিদা গোটা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে রয়েছে। তাই জেলার রায়গঞ্জ এবং হেমতাবাদের চাষিদের তুলাইপাঞ্জি চাষে উৎসাহ দেওয়া হয়। ফলে গত কয়েক বছরের মধ্যে তুলাইপাঞ্জির জমির পরিমাণ যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে ফলনও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জেলার কৃষি দপ্তর জানিয়েছে যদিও সেই সংখ্যা বাড়বে । জেলা কৃষি অধিকর্তাদের মত অনুযায়ী, 'সুগন্ধী ধান চাষের জন্য রাজ্য সরকারের তরফে বাংলায় প্রকল্প চালু হয়েছে। জেলার নিজস্ব তুলাইপাঞ্জি আবাদে কৃষকদের বিনামূল্যে তুলাইয়ের বীজ সরবরাহ করা হয়। তুলাইয়ের চাহিদা গোটা রাজ্যে রয়েছে। তাই জেলার রায়গঞ্জ এবং হেমতাবাদের চাষিদের তুলাইপাঞ্জি চাষে উৎসাহ দেওয়া হয়।
ফলে গত কয়েক বছরের মধ্যে তুলাইয়ের জমির পরিমাণ যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে ফলনও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। 'তুলাইপাঞ্জি ধানের জীববৈচিত্র্য যাতে কেউ চুরি করতে না পারে, সেই কারণে ২০১৭ সালে জিআই অর্থাৎ জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তুলাইপাঞ্জি।'
রায়গঞ্জ শহর সংলগ্ন কর্ণজোড়া এলাকায় তুলাই ধান ভাঙার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্র বসানো হয়েছে। কৃষকদের এই ধান চাষে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য রাজ্য সরকারের তরফ থেকে একাধিক সুযোগসুবিধা দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
ليست هناك تعليقات:
إرسال تعليق